বাচ্চাদের ভ্যাক্সিন দেওয়া, মায়েদের টিটি টিকা দেওয়া নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক কনফিউশান। এটা নাকি ইহুদিদের ষড়যন্ত্র। আসলেই কি তাই? আসুন বিষয়টা বিশ্লেষণ করা যাক।
এই বাংলাদেশেই এক সময় ওলা বিবি, বসন্ত বিবি, কলেরা বিবি, যক্ষা বিবিদের আক্রমণে এক একটা গ্রাম উজাড় হয়ে যেত, একসাথে প্রচুর মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত। তখন এসব রোগ-বালাইকে যমদূত বলে মনে করত মানুষ। ‘যক্ষ্মা হলে রক্ষা নাই’ এটা তো বাঙালি সমাজেরই একসময়ের প্রচলিত স্লোগান। এখন কলেরা, যক্ষ্মায় ক’জন মানুষ মারা যায়? এডওয়ার্ড জেনার গুটিবসন্তের ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের পর থেকে ধীরে ধীরে বাংলাদেশসহ পৃথিবী থেকেই এই রোগ অনেকটা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পোলিও বিলুপ্তির পথে। রোগ-বালাই দূর হয়ে যাওয়াটা আমাদের জন্য ভালো ছিল, না খারাপ? আরেকটু বিস্তারিত জানতে এই আর্টিকেলটি পড়ুন :
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার ছিল হাজারে ২২২.৭ জন। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি ও চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে আল্লাহর রহমতে মৃত্যুর সেই হার কমে এখন হাজারে মাত্র ২৫.৭ ।
গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যুর হার ছিল ১৯৭৫ সালে লাখে ৬০০ জনের মতো। টিটি টিকা ও চিকিৎসা সচেতনতার মাধ্যমে আল্লাহর রহমতে তা কমে ২০১০ নাগাদ হয়েছে ১৯৪ এর মতো।
এসব কীভাবে ইহুদিদের ষড়যন্ত্র হলো?
অনেকে বলছেন যে, টিকা না নিয়েও অমুক-তমুক ভালো আছেন। আল্লাহ তো আসলেই টিকার মোহতাজ নন, টিকা ছাড়াও আল্লাহ ভালো রাখতে পারেন। সেই ব্যাখ্যায় পরে আসছি। আমি নিজেও কিন্তু ইম্যুনাইজড না, আমিও তো ভালো আছি, আলহামদুলিল্লাহ। তবে মেডিকেল সাইন্সে এর ব্যাখ্যা হচ্ছে—একটা সমাজের মাক্সিমাম মানুষ ভ্যাক্সিনেটেড থাকলে বাকিদেরও অটো প্রটেকশন হয়ে যায়। কমিউনিটি মেডিসিনে এটার নাম ‘হার্ড ইমিউনিটি’। এ জন্যই অনেকে টিকা না নিলেও তাদের সমস্যা হয় না, বা হচ্ছে না। কিন্তু এভাবে একজন একজন করে সবাই টিকা না নিতে থাকলে এই হার্ড ইমিউনিটি আর বাকি থাকবে না। সেটার প্রমাণ কিন্তু পরিসিংখ্যানেও আছে। ২০১০ সালে মাতৃমৃত্যুর হার কমে হয়েছিল ১৯৪, সেটা ২০১৬ সাল নাগাদ আর কমেনি, উলটো বেড়ে গিয়ে হয়েছে ১৯৬। তো এরকম সবাই যদি টিকা বন্ধ করে দিয়ে এই হার্ড ইমিউনিটিটা ভেঙে ফেলে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আবারও আমাদের দেশ ও সমাজ ১৯৯০ বা ১৯৭১-এর পরিসংখ্যানে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, ইল্লা মাশাআল্লাহ। মনে রাখতে হবে—দায়বদ্ধতা শুধু এখানে সরকারের একার না। আমারও...আপনারও।
বলা হচ্ছে, টিটি টিকার কারণে নাকি নর্মাল ডেলিভারিতে সমস্যা হয়। আমি নিজে এবং আমার ভাবি দুজনই টিটি দিয়েছি এবং আমাদের দুজনের বাচ্চাই নরমালে হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ। টিটি মানে হচ্ছে টিটেনাস টক্সয়েড। একসময় মায়েদের গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন ধনুষ্টংকারে প্রচুর মা মারা যেত এবং জন্মের পর শিশুরাও ধনুষ্টংকারে মারা যেত। আমার নিজেরই বড়ো ভাই ১৯৮৬ সালে মারা গেছে ধনুষ্টংকারে (Tetanus neonatarum) মাত্র ৩ দিন বয়সে। টিটেনাসের এই হার কমাতেই কিশোরী মেয়েদের, মায়েদের এবং শিশুদেরও টিটি টিকা দেওয়া হয়। আপনার কী মনে হয় তাতে কোনো লাভ হয়নি? যে যুগে এই টিকা দেওয়া হতো না, সেই যুগের সাথে এ যুগের পরিসংখ্যান মিলিয়ে দেখুন, কী আমূল পরিবর্তন! এই টিকায় নর্মাল ডেলিভারি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এই কথার পেছনে প্রমাণ কী??
উন্নত দেশগুলোতে যাবতীয় টিকা দেওয়ার পরও নরমাল ডেলিভারির হার আমাদের দেশের তুলনায় অনেক বেশি। এর পেছনে টিটির কোনো ভূমিকা আছে বলে প্রমাণ নেই। সব ডাক্তার আন্তরিক নয়, এটা যেমন সত্য, তেমনি পুরোটা দায় শুধু ডাক্তারদেরও নয়। উন্নত দেশগুলোতে একজন মা কনসিভ করার পর থেকে বাচ্চা জন্মদান পর্যন্ত পুরোটা সময় তাকে অবজার্ভ করা হয়, পরামর্শ দেওয়া হয়, বিভিন্ন ট্রেনিং দেওয়া হয়। আর এই দায়িত্ব মূলত পালন করে ‘মিডওয়াইফারি সিস্টেম’, যেটা বাংলাদেশে এখনো সেভাবে চালু হয়নি। আর উন্নত দেশগুলোর মতো মানুষও তেমন সচেতন না । এজন্য ডাক্তাররা চাইলেও একা অনেক কিছু করতে পারেন না। আর হ্যাঁ, প্রাইভেট ক্লিনিকে ব্যবসায়ী স্বার্থে অনেক সিজারিয়ান ডেলিভারি হলেও সরকারি হাসপাতালগুলোতে কিন্তু ৮০% ডেলিভারি নরমালেই হয়। ওখানে সিজার করার জন্য ডাক্তার টাকা পায় না, বরং সিজারের জন্যই ডাক্তারের বেশি কষ্ট করতে হয়, নরমাল ডেলিভারিই সহজ; তাই পারতপক্ষে রোগীকে ওটিতে ওঠাতে কেউ চায় না। তো নরমাল ডেলিভারি রেট বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন ডাক্তারদের আন্তরিকতা ও সাহস (এই সাহসে প্রচুর ঘাটতি আছে, এটা সত্য) এবং সাধারণ মানুষের জানাশোনা, সদিচ্ছা, সাহস ও সচেতনতা, আর উন্নত দেশগুলোর মতো ‘মিডওয়াইফারি সিস্টেম’ চালুকরণ। এগুলোর কোনোটাকে দায়ি না করে টিটি টিকাকে কেন দায়ি করা হচ্ছে, এটা আমিসহ বেশিরভাগ ডক্টরেরই জানা নেই!
বলা হচ্ছে, উন্নত দেশগুলোতে নাকি বাচ্চাদের টিকা দেওয়া হয় না, ইহুদিরা ষড়যন্ত্র করে শুধু মুসলিম দেশগুলোতেই চাপিয়ে দিচ্ছে। অথচ খোঁজখবর নিয়ে দেখলে যে বিষয়টা জানা যায়, উন্নত দেশগুলোতে টিকা দেওয়ার হারটা মুসলিম দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। সদ্যজাত শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধবয়স্ক পর্যন্ত সবার ভ্যাক্সিনেশান শিডিউল আছে৷ তেমন কয়েকটি ন্যাশনাল ভ্যাক্সিনেশন শিডিউলের ছবি দিচ্ছি। গুগলে সার্চ করে আপনি নিজেও দেখে নিতে পারবেন।
ইন্ডিয়া :
ইউএসএ :
অস্ট্রেলিয়া :
ইউকে :
সব দেশে সবরকম রোগের প্রাদুর্ভাব নেই, যে দেশে যে রোগের প্রকোপ বেশি, সেখানে সেই টিকা দেওয়া হয়; ইহুদি-নাসারা-হিন্দুদের দেশেও দেওয়া হয়। তাহলে শুধু মুসলিমদের ক্ষেত্রে তা ইহুদিদের ষড়যন্ত্র হলো কী করে?
এবার আসি অন্য কথায়—চিকিৎসা কি তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী? না, স্বয়ং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই বলেছেন চিকিৎসা গ্রহণ করতে, উনি নিজেও চিকিৎসা নিয়েছেন, ‘রুকইয়া’ করিয়েছেন। আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা সমসাময়িক চিকিৎসা সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জ্ঞান রাখতেন, এর কারণ, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেষ বয়সে তাকে চিকিৎসা দিতে দূর-দূরান্ত থেকে চিকিৎসকরা আসত, আয়শা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাদের কাছ সেসব থেকে শিখে রাখতেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির কারণে রোগ বিলুপ্ত হয়ে গেছে, মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যুর হার কমে গেছে—তার মানে কি আল্লাহর চাইতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষমতা বেশি? না, মোটেই না। বিজ্ঞানীরা যা করছেন, তা আল্লাহর দেওয়া জ্ঞান ও মেধা খাটিয়েই করছেন। মাথা ব্যথা হলে আমরা প্যারাসিটামল খাই, তার মানে এই না যে আল্লাহ প্যারাসিটামল ছাড়া মাথা ব্যথা কমাতে অক্ষম। ওষুধ কাজ করে আল্লাহর আদেশেই। আল্লাহ আসবাবের মাধ্যমে আমাদের অভাব পূরণ করেন, এটাই জগতের নিয়ম; কিন্তু আল্লাহ আসবাবের মুখাপেক্ষী নন। যেমন আল্লাহ চাইলে চাকরিবাকরি ছাড়াও আমাদের রিযিকের ব্যবস্থা করতে পারেন, কিন্তু করেন না। বরং চেষ্টা-তদবির করে আমাদের রিজিকের সন্ধান করতে হয়—এটাই সৃষ্টিজগতের বিধান। এই বিধানের সাথে তাওয়াক্কুলের কোনো সংঘর্ষ নেই। সহিহ বুখারির এক হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই বলছেন —
مَا أَنْزَلَ اللَّهُ دَاءً إِلَّا أَنْزَلَ لَهُ شِفَاءً-
আল্লাহ তায়ালা এমন কোন রোগ পাঠাননি, যার চিকিৎসা পাঠাননি।
সহিহ মুসলিমের আরেকটি হাদিসে বিষয়টা আরো সুস্পষ্টভাবে এসেছে,
لِكُلِّ دَاءٍ دَوَاءٌ فَإِذَا أُصِيبَ دَوَاءُ الدَّاءِ بَرَأَ بِإِذْنِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ
প্রত্যেক রোগেরই চিকিৎসা রয়েছে। যে কোনো রোগের সঠিক চিকিৎসা দেওয়া হলে, আল্লাহ তায়ালাআদেশেই তা রোগমুক্তি দিয়ে থাকে।
সুতরাং রোগের চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা করা, সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করা, যথাযথভাবে প্রতিষেধক ব্যবহার করা—এগুলোর কোনোটিই অনৈসলামিক নয়, বরং সঠিক নিয়তে করা হলে তা আল্লাহর নেয়ামতের অনুসন্ধান ও রাসুলের সুন্নাহর অনুসরণ বলে সাব্যস্ত হবে, ইনশাআল্লাহ।
ইসলামি ফিকহের একটা মূলনীতি হচ্ছে, ‘আসল’ হলো মানুষের নিরপরাধ হওয়া, এখন তাকে অপরাধী প্রমাণ করতে চাইলে আপনাকে প্রমাণ দিতে হবে। বিষয়টা আরেকটু খোলাসা করে বলি—একজন মানুষের স্বাভাবিক অবস্থা হলো সে চোর নয়, এখন আপনি যদি তাকে চোর বলতে চান, তাহলে আপনাকে প্রমাণ দিতে হবে। সে যে চোর নয়, তার জন্য তাকে প্রমাণ দিতে হবে না, কারণ মানুষের স্বাভাবিক অবস্থাই হলো তার ভালো হওয়া। এখন কাউকে অস্বাভাবিক প্রমাণ করতে হলে আপনাকে অবশ্যই প্রমাণ দিতে হবে। তেমনি, টিকাগুলো আবিস্কৃত হয়েছেই যুগ যুগ ধরে গবেষণার পর; একেকটা রোগের প্রতিষেধক হিসেবে—এটাই টিকার ‘আসল’ অবস্থা। এটা যে ইহুদিদের ষড়যন্ত্র, এটা যে মুসলিমদের বিকলাঙ্গ করে দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে, এটা বলতে হলে শুধু মুখের কথাই যথেষ্ট নয়, আপনাকে অবশ্যই সুস্পষ্ট প্রমাণ দিতে হবে। অমুক আলেম বলেছেন, অমুক আর্টিকেলে পড়েছি ইত্যাদি ইত্যাদি... এগুলো আসলে যেমন কোনো দলিলই নয়, তেমনিভাবে কোনো লজিকও নয়৷ আর আমি কিংবা আমরা ডাক্তার-সমাজ এরকম কোন সন্তোষজনক প্রমাণ আজও পাইনি। তাহলে প্রমাণ ছাড়াই এই তথ্য প্রচার করা ইসলামেরই পরিপন্থী নয় কি?
(কেউ যদি সত্যিই কোন দলিল/প্রমাণ দিতে পারেন এবং আমাদের বিশ্বাসভাজন ইসলামপন্থী ডাক্তারেরা তাতে কনভিন্স হন, তবে তা প্রচার ও প্রসারের দায়িত্ব আমি, আমরাই তুলে নেবো, ইনশআল্লাহ। কমেন্টে জানাবেন, আশা করি?)